আবারো পূর্ববাংলা-জাসদ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে, অশান্ত ঝিনাইদহের জনপদ

দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহ। একটি সময় চরমপন্থিদের অভয়ারণ্য হিসেবে বিশেষ পরিচিতি ছিলো এ জেলা সহ আশেপাশের জেলাগুলোর। দীর্ঘদিন শান্ত থাকলেও আবারো চরমপন্থি নেতাসহ ৩ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আলোচনায় এসেছে এ জেলা। সেইসাথে আলোচনায় অবৈধ অস্ত্রধারীদের আনাগোনার কথা। হত্যার পর জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু দায় স্বীকার করে একটি ক্ষুদে বার্তা দিয়েছেন জেলায় কর্মরত সংবাদকর্মীদের। ওই ক্ষুদে বার্তায় লেখা আছে, “এতদ্বারা ঝিনাইদা, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বাশির উদ্দেশ্যে জানানো যাইতেছে যে, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিনাকুন্ডু নিবাসী মোঃ হানিফ তার দুই সহযোগী সহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। অত্র অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে- কালু জাসদ গণবাহিনী”।

স্থানীয়রা জানান, কালু কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং জাসদ গণবাহিনীর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা।

হত্যাকান্ডের শিকার তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে তাদের পরিবার। তাঁরা হলো, ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার আহাদননগর গ্রামের রাহাজ উদ্দিনের ছেলে পূর্ববাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি জনযুদ্ধের (লাল পতাকা) সামরিক কমান্ডর হানিফ আলী(৫৬), তার শ্যালক ও একই উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের উম্মাদ আলীর ছেলে লিটন হোসেন(৩৮) এবং কুষ্টিয়া জেলার ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের আরজান হোসেনের ছেলে রাইসুল ইসলাম রাজু(২৮)। রাইসুলের মরদেহ ধান ক্ষেতের পানির মধ্যে থাকলেও হানিফ ও লিটনের মরদেহের পাশে ছিল দুটি পালসার মটোরসাইকেল ও হেলমেট। তাদের প্রত্যেকের মাথায় ও বুকে গুলির চিহ্ন রয়েছে।

এদিকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় আগে নিহতদের প্রত্যেককে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও তাদের পরিবারের সদস্যরা বলতে পারেনি কারা তাদের মোবাইলে কল দিয়েছিল।

জানা যায়, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ-লাল পতাকা) সামরিক কমান্ডার হানিফ ৯০ দশকে হরিনাকুন্ডু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় হত্যা ডাকাতির মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৪ টি হত্যাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে। ৭/ ৮ বছর ধরে হরিনাকুন্ডুর নারায়নকান্দি এলাকায় বাওড় দখল করে মাছ চাষ করে আসছিল হানিফ। ২০১৪ সালে সে জেল থেকে বের হয়ে পরে ২০১৭ সালে ঐ বাওড়ের মৎসজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউল হককে গুলি করে হত্যা করে বাওড়ের দখল নেয়। সাম্প্রতি বাওড় দখলকে কেন্দ্র করে কয়েকটি চরমপন্থী গ্রুপের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এসব কারনে জাসদ গণবাহিনী তাকে হত্যা করে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে। হরিনাকুন্ডুর কুলবাড়িয়ার আব্দুর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অপরাধে হানিফের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। হানিফের এক ভাই হড়িনাকুন্ডু উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোঃ রফিক, আরেক ভাই উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি ও হরিনাকুন্ডু উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুল ইসলাম এশা। হানিফ নিজেও হরিনাকুন্ডু উপজেলা মৎসজীবী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বলে জানা যায়। এছাড়া নিহত অপর দুই ব্যক্তি জনযুদ্ধের সামরিক কমান্ডর হানিফের সহযোগী বলে ধারনা করা হচ্ছে।

এদিকে হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল শৈলকুপার ত্রিবেণী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশান ঘাটের ওই স্থান থেকে রাতেই শর্টগানের ৭ রাউন্ড ও পিস্তলের ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে শুধুমাত্র শর্টগানের ৪ রাউন্ড গুলি বিষ্ফারিত ছিল।

শৈলকুপা থানায় আসা নিহতদের স্বজনদের সাথে কথা বল জানা যায়, হানিফ আলীর সাথে সম্প্রতি ৫ আগস্টের পর হরিনাকুন্ডু উপজেলার রামদিয়া বাওড়ের দখল নিয়ে পাশ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলার তিয়োড়বিল এলাকার বিএনপির কছু মানুষের সাথে বিরোধ তৈরি হয়। প্রায়ই তারা বাওড়ের মাছ মেরে নিত বলেও জানানো হয়। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি।

নিহত হানিফের ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম এশা বলেন, শুক্রবার বিকালে ভাইয়ের মোবাইলে একটি কল আসে। এরপরই কিছু না বলে সে বড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। পরে রাতে তার মৃত্যুর খবর পাই। বাওড়ের মাছ ধরা নিয়ে স্থানীয় কিছু মানুষের সাথে বিরোধ চলছিল। এর জেরে হত্যাকান্ডটি হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।

রাইসুলের মামা লিটন হোসেন বলেন, রাইসুল কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামে নানা বাড়িতে থাকতো। রাইসুল লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলো। ছাত্রাবস্থায় কুষ্টিয়ার একজন সাংসদের সাথে তার সখ্যতা ছিলো। শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয় সে। এরপর রাতে তারা সংবাদ পান রাইসুলকে হত্যা করা হয়েছে। রাইসুল এলাকায় কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিল না বলে মামা লিটন হোসেন দাবী করেন।

রামচন্দ্রপুর গ্রামের মাসুদ রানা বলেন, শুক্রবার রাত ৮টার দিকে তারা ৪টা গুলির শব্দ শুনতে পায়। এরপর এলাকাবাসীরা ঘটনা জানার চেষ্টা করে কোন কিছু উদ্ধার করতে পারে না। পরে রাত ১০টার দিকে পুলিশ আসলে জানা যায় শ্বশান ঘাটে গুলিবিদ্ধ তিনটি লাশ পড়ে আছে। পাশে আছে দুটি মোটরসাইকেল ও দুটি হেলমেট, একটি বস্তা ও একটি বাজারের ব্যাগ। এর আগেও এই মাঠে আলোচিত “ফাইভ মার্ডার” হত্যাকান্ড ঘটেছিলো।

শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুম খান বলেন, গুলিবিদ্ধ তিনটি মরদেহ শুক্রবার রাতেই উদ্ধার করে শৈলকুপা থানায় নিয়ে আসা হয়। নিহতের স্বজনরা তাদের নাম পরিচয় নিশ্চিত করেছে। লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে।

ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মোঃ ইমরান জাকারিয়া ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ চরমপন্থি নেতা হানিফসহ ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে জাসদ গণবাহিনীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, এ হত্যাকাণ্ডটি জাসদ গণবাহিনী ও পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলে হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *