রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নে এক সুবিস্তৃত জলাশয়, যা আজ “নীল দরিয়া” নামে পরিচিত, নীরবে বহন করে চলেছে এক বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস। একসময় এটি ছিল উত্তর জনপদের প্রভাবশালী রাজা নীলাম্বর দেবের রাজকীয় রাজধানী, যার শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই গভীর জলাশয়। এই জলাশয়টি মূলত সেই দুর্ভেদ্য রাজধানীর প্রতিরক্ষামূলক পরিখা, যা সময়ের পরিক্রমায় নাম পরিবর্তন করে পরিচিতি লাভ করেছে নীল দরিয়া নামে।
অতল গভীরতার আড়ালে রাজকীয় স্থাপত্যের রহস্য:
কথিত আছে, প্রায় ৫৪ একর জমির উপর রাজা নীলাম্বর তার সুবিশাল রাজধানী গড়ে তুলেছিলেন। বহিরাক্রমণ থেকে রাজধানীকে সুরক্ষিত রাখতে এর চারপাশে খনন করা হয়েছিল প্রায় ৮০ হাত প্রস্থের এক গভীর পরিখা। এই পরিখার মাটি ব্যবহার করে রাজধানীর সীমানায় নির্মাণ করা হয়েছিল ১৪ হাত প্রস্থ ও ১৪ হাত উঁচু এক সুবিশাল প্রাচীর। এই প্রাচীর এবং গভীর পরিখা রাজা নীলাম্বরের দূরদর্শিতা ও রণকৌশলের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তবে, ১২’শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে এই পরিখার উত্তর-পূর্ব অংশ ভরাট হয়ে যায়। অবশিষ্ট তিন ধারের জলাশয় তার অতল গভীরতার কারণে কালক্রমে এলাকাবাসীর কাছে “নীল দরিয়া” নামে পরিচিতি লাভ করে। এই গভীর জলাশয়ের কারণেই পরিত্যক্ত রাজধানীর অধিকাংশ ভবন মাটির নিচে দেবে যায়, যা আজও এক রহস্যের আড়ালে। ধারণা করা হয়, এই গভীরতার কারণেই ভবনগুলো অক্ষত অবস্থায় মাটির নিচে সংরক্ষিত রয়েছে, যা ভবিষ্যতের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
বিস্মৃতি থেকে নজরে আসার গল্প:
শত বছর ধরে পরিত্যক্ত থাকায় এই ঐতিহাসিক স্থানটি একসময় সাধারণ মানুষের কাছে প্রায় অপরিচিত হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষ হয়তো নির্জনতা খুঁজতে এখানে আসত। পরবর্তীতে বন বিভাগ এখানে বনায়ন করে, যা স্থানটিকে কিছুটা পরিচিতি এনে দেয়। একসময় এই বনায়ন বিক্রিও করা হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে বর্তমান প্রজন্মের কাছে নীল দরিয়া আবারও নজর কাড়ে, ইতিহাসের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। স্থানীয়দের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এই স্থানটির প্রাচীন ইতিহাস ও রহস্যময় গল্প।
নীল দরিয়াকে ঘিরে নতুন করে আগ্রহ জন্মানোর পর থেকেই চতরা থেকে নীল দরিয়া পর্যন্ত রাস্তা পাকা করার দাবি ওঠে। এই দাবি স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান ঘটিয়েছে এবং নীল দরিয়ার প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বাড়িয়েছে। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে এই প্রাচীন রাজকীয় স্মৃতিচিহ্ন দেখতে।
ইতিহাসের পাঠশালা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:
নীল দরিয়া শুধু একটি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ নয়, এটি ইতিহাসের এক জীবন্ত পাঠশালা। এখানকার নিস্তব্ধতা যেন এখনও রাজা নীলাম্বরের শাসনামলের গল্প শোনায়। এখানকার প্রতিটি ধূলিকণা এবং জলের প্রতিটি ঢেউে লুকিয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকা এক মহিমান্বিত ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। একই সাথে, চারপাশের সবজুে ঘেরা পরিবেশ এবং নীল জলাশয়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এটিকে একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানে পরিণত করেছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকরা এখানে আসে ইতিহাসকে কাছ থেকে জানতে এবং প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে সময় কাটাতে।
পর্যটকরা এখানে এসে একদিকে যেমন রাজা নীলাম্বরের ইতিহাসের গভীরে ডুব দিতে পারেন, তেমনি অন্যদিকে নীল দরিয়ার শান্ত জলে নৌবিহার করে বা এর পাড়ে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। এই স্থানটি কেবল একটি ঐতিহাসিক নিদর্শনই নয়, এটি একটি শান্ত ও প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল, যা আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্তির এক অনবদ্য সুযোগ করে দেয়। নীল দরিয়া যেন এক নীরব আহ্বানে পর্যটকদের ডেকে বলে তার হারানো রাজ্যের গল্প শুনতে, যা আজও অতল জলের গভীরে এক রহস্যময় অতীতে ঢাকা পড়ে আছে।
