বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রায়গ্রাম বাঁশতলা স্লুইসগেট রক্ষার নৈতিক দায়িত্ব ভুলে ব্যক্তিস্বার্থে সরকারী জায়গা দখল নিয়ে দুই পক্ষ প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে পুলিশ একাধিকবার ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয় পক্ষকে শান্ত থাকতে বলেছে। কিন্তু পুলিশ বলে চলে গেলে আবারো জায়গা দখল তৎপরতা অব্যাহত থাকে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান।
২০২৪ সালের ০৫ আগস্ট পরবর্তীকালে ওই গেটের সরকারী জীর্ণ খালাসীঘরে সাবেক গেটখালাসির পরিবার এসে বসবাস শুরু করেন এবং ক্রমাগতভাবে জায়গা দখল করায় এই বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে চরমে। এই বিষয়ে বাগেরহাট পাউবো কর্মকর্তা ও চিতলমারী থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
জানা গেছে, ০৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে প্রতিবেশী টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী বাজার এলাকার ফিরোজা বেগম নামক এক ব্যক্তি তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে চিতলমারী উপজেলার রায়গ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁশতলা স্লুইসগেটের পুরনো সরকারি ভবন দখল করে বসবাস শুরু করে। তারা আশপাশের জমি, অন্যের মাছের ঘের নিজেদের দখলে নিচ্ছে। ফিরোজা বেগম এই স্লুইসগেটের সাবেক গেটখালাসি মৃত রতন মোল্লার স্ত্রী।
স্থানীয়দের দাবি, ফিরোজা বেগমের নাতি (বড় মেয়ের ছেলে) রুবেল হাওলাদারের নেতৃত্বে দখলদারিত্ব, হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। ভুক্তভোগীদের পক্ষ হতে প্রকাশ রায়, তাপস বিশ্বাস, শুখলাল অধিকারী চিতলমারী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে উল্লেখ করেন, একটি হত্যা মামলায় রুবেল ঢাকায় জেলে ছিলেন এবং সেখান থেকে বেরিয়ে তার নানা-নানীর সূত্রে সম্প্রতি রায়গ্রামে এসে একের পর এক জায়গা দখল করছে। ঘেরের মাছ ধরে নিচ্ছে। বাধা দিলে মারতে তাড়া করছে এবং হুমকি দিয়ে চলেছে। মাটি কেটে নতুন বসতি তুলছে। থানায় অভিযোগ করায় ওদের ক্ষিপ্রতা বেড়েছে। পুলিশ বার বার এসে শান্ত থাকতে বলার পরেও ফিরোজা, রুবেল ও তার সঙ্গীরা পুলিশ চলে যাওয়ার পর তাদের দখল তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
ভুক্তভোগী প্রকাশ রায় , তাপস বিশ্বাস সহ কয়েকজন জানান, রুবেল হাওলাদারের নানা অর্থাৎ ফিরোজা বেগমের স্বামী রতন মোল্লা ২০-২৫ বছর আগে ওই স্লুইসগেটের গেটখালাসী হিসেবে চাকুরী এবং সরকারী ঘরে বসবাস করতেন। হঠাৎ রতন মোল্লার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ফিরোজা বেগম ২০১৩ সালে গেটখালাসীর সরকারী পাকা বসতঘরের সামনে থাকা একখানা টিনের ঘর স্থানীয় পুলকেশ রায়ের (থানায় অভিযোগকারী প্রকাশ রায়ের ভাই) কাছে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে সন্তান-আত্মীয়দের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের আগস্ট পরবর্তীকালে তারা এই এলাকায় এসে দখলদারিত্বের মাধ্যমে অশান্ত করে তুলছে। বিষয়টি বাগেরহাট পাউবোকে লিখিতভাবে জানানোর পরেও কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ।
এই বিষয়ে সাবেক গেটখালাসি রতন মোল্লার স্ত্রী ফিরোজা বেগম জানান, এই গেট এলাকায় তার স্বামীর কবরস্থানসহ নানা স্মৃতি রয়েছে। তিনি কিছুদিন ধরে স্বামীকে স্বপ্ন দেখছেন। তাই পাউবোতে লিখিত আবেদন করে স্মৃতিবিজড়িত পরিত্যক্ত সরকারী খালাসি-বসতঘরে উঠেছেন। তারা সরকারী জায়গায় বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে ফসল লাগিয়েছেন। কারো ব্যক্তিগত জায়গা বা ঘের তারা দখল করেননি বলে দাবি করেন।
ফিরোজা বেগম আরো বলেন, এই গ্রামের মৃধাবাড়ি সহ অনেক হিন্দুদের সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক। নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে অনেক হিন্দু ব্যক্তিকে বাঁচিয়েছেন। হিন্দু -মুসলমানে এই সুসম্পর্ক ভালভাবে নিতে না পেরে তাপস বিশ্বাস, প্রকাশ রায়, মহানন্দ অধিকারী, সুখ অধিকারী, নিখিল রানা, বুদ্ধ অধিকারীর লোকেরা বহু অত্যাচার করেছিল। অনেক ঘটনার বিচার করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান মোহন আলী বিশ্বাস তাদের রক্ষা করেন। এক পর্যায়ে ২০১৩ সালে এই গ্রাম ছেড়ে তিনি বড় মেয়ের কাছে চলে যান। বড় মেয়ের ছেলে রুবেল হাওলাদার মানিকগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির সামনে খাবার হোটেল ব্যবসা করতো। শেখ হাসিনা ২০২৪ সালে দেশ ছেড়ে পালানোর পরে তিনি স্বামীর কবরস্থানের টানে রায়গ্রাম ফিরে এসেছেন বলে জানান।
ফিরোজা বেগম আরো জানান, টূঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী বাজার এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও তিনি ও তার ছোট মেয়ে চিতলমারীর রায়গ্রামের ভোটার। তাই এখানে তাদের থাকার অধিকার আছে। এই গেট এলাকায় পাউবোর সার্ভেয়ার মোঃ নাইমুল হকের নেতৃত্বে একটি দল গত রমজানের দুই সপ্তাহ আগে তাদের ১২০ শতক (এক একর ২০ শতক) জায়গা মেপে লাল ফিতে টানিয়ে পিলার পুঁতে বুঝিয়ে দিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। intertogel
এদিকে, ফিরোজা বেগমকে রায়গ্রাম স্লুইসগেটের খালাসীঘরে বসবাস ও গেট এলাকা রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে পাউবো মোল্লাহাট অফিসের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিরাজ মোল্লা ২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবর বাগেরহাট নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে একটি পত্র প্রেরণ করেন। যার স্মারক নম্বর ১৮৪। এই পত্রের ভিত্তিতে ফিরোজা বেগম আত্মীয় নিয়ে জায়গা দখল করে চলেছেন বলে অভিযোগ।
একজন প্রবীণ বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ধীরে ধীরে গেটের চারপাশ ঘিরে নেওয়া হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে ভয় দেখানো হয়। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই দখল ঠেকানো সম্ভব নয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তফা তালুকদার জানান, পদাধিকারবলে রায়গ্রাম বাঁশতলা স্লুইসগেটের স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির তিনি সভাপতি। রায়গ্রাম বাঁশতলা স্লুইসগেট কচুরিপানার আটকে আছে। এখানে “গেট এলাকা” হিসেবে তিন একর জায়গা রয়েছে – যা গেটের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হওয়ার কথা। গেটের জায়গা গেটের উপকারে আসছে না। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ও সাবেক গেটখালাসির পরিবার গেট রক্ষার কথা ভুলে ব্যক্তিস্বার্থে বিরোধে জড়িয়েছে। বিষয়টি নিরসনের জন্য প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য, “এই বিষয়ে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল বারুনী বলেন, সাত-আট মাস আগে আমি নিজে ওই স্লুইসগেটে গিয়ে সাবেক গেটখালাসির অবস্থান ও জায়গা দেখে এসেছি। দুই-একজন লোক এলাকায় অযথা অশান্তির চেষ্টা করছে। তারপরও আমি বিষয়টি দেখবো।”
“স্থানীয় বাসিন্দাগণ, জনপ্রতিনিধি ও সাবেক খালাসী সহ সকলের দায়িত্ব স্লুইসগেট ও গেট এলাকার নির্দিষ্ট জায়গা জনস্বার্থে সংরক্ষণ করা। কিন্তু এই নৈতিক দায়িত্ব ভুলে গেটের সংরক্ষণ-বিরোধী কাজ করাটা অপ্রত্যাশিত। সাবেক গেটখালাসির পরিবার ওই স্লুইসগেটের খালাসীঘরে বসবাস করার আবেদন করেন এবং স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
