শত শত বছর আগেও মানুষ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতো। তখন এখনকার মতো হাতে হাতে সময় দেখার যন্ত্র ছিলো না। তবে সেসময় সময়কে ছাপিয়ে যাবার জন্য বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার করে। যার নাম সূর্যঘড়ি বা সানডায়াল। সূর্যের মাধ্যমে সময় দেখার সেই আবিষ্কার কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। তবে এখনো যশোরে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে মৃত সূর্যঘড়ি।
আজ থেকে আনুমানিক ২শ ৩২ বছর আগে যশোরে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক কাজে সময় নির্ণয়ের জন্য তৎকালীন কালেক্টরেট ভবন প্রাঙ্গণে সূর্যঘড়িটি নির্মাণ করা হয়। যার বর্তমান অবস্থান শহরের জেলা রেজিস্ট্রি অফিসে, যেটি ছিল দেশের প্রথম কালেক্টরেট ভবন। যশোরের এই সূর্যঘড়িটির ঐতিহাসিক মূল্য থাকলেও প্রত্ননিদর্শনটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। এমনকি যশোর শহরের বেশির ভাগ মানুষই জানে না তাদের জেলায় সূর্যঘড়ি রয়েছে।
রেজিস্ট্রি অফিসের পশ্চিম পাশে দলিল লেখকদের শেড। সেই শেডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে করা হয়েছে একটি ঘর। ঘরটি সামান্য অংশ ফাঁকা রেখে মাঝখানে টিনের বেড়া দিয়ে বিভক্ত করা হয়েছে দুই অংশে। বিভক্ত অংশের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়া-আসার জন্য সামান্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। ঘরটির দুই অংশেই সারি সারি কম্পিউটার প্রিন্টার। সেখানে দলিল লেখকদের কাজ চলছে। জানা না থাকলে দেখে বোঝার উপায় নেই সূর্যঘড়িটি ঘিরে নিয়ে কক্ষটি নির্মাণ করা। পুরো কক্ষটিই আসলে সূর্যঘড়ির অংশের ওপর নির্মিত। সব মিলিয়ে বোঝা গেল, নানা অত্যাচার চলেছে তার ওপর। সূর্যঘড়িটি সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত বহু বছর। এখন যেন তার অপেক্ষা অবিবেচক মানুষদের লোভের অত্যাচারে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার। তবে প্রত্ন-ঐতিহ্য বিবেচনায় এটির যথাযথ সংরক্ষণের দাবি যশোরবাসীর।
পৌর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, যশোরে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে এটি আমাদের অজানা। যদিও এই নিদর্শনটি ভ্রমণপ্রিয় মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকেও এই সূর্যঘড়ির সাথে পরিচিত হওয়া উচিৎ ছিলো।
তিনি বলেন, দুঃখের বিষয় এমন একটি ঐতিহ্যকে আমরা অযত্ন অবহেলায় ফেলে রেখেছি। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ ও জেলা প্রশাসন কেউই এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। আমাদের দাবি দ্রুত সূর্যঘড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হোক।
যশোর সরকারি এম এম কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহজাহান কবীর বলেন, ‘যশোর জেলার আছে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ব্রিটিশ সরকারের আমলে অবিভক্ত বাংলার সর্বপ্রথম কালেক্টরেট ভবন নির্মাণ করা হয় এখানে, যেখানে সূর্যঘড়ি স্থাপন করা হয়। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে সেখানে রেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রম চলমান থাকায় সাধারণ মানুষ দুর্লভ ঘড়িটি দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণের পরিপন্থী। তাই সাধারণ মানুষের জন্য সূর্যঘড়িটি সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত রেখে এবং যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে যশোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষা করার উচিৎ।
সূর্যঘড়িটি রক্ষাণাবেক্ষণের বিষয়ে যশোরের জেলা রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ আবু তালেব জানিয়েছেন, এটি অনেক প্রাচীন একটি নিদের্শন। আমি এখানে যোগদান করার পরপরই সূর্যঘড়িটি দেখতে গেছিলাম। সেখানে বর্তমানে দলিল লেখকদের ঘর রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। দ্রুত কিভাবে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটিকে সংস্কার করে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা যায় সেবিষয়ে আমরা কাজ করছি।
এদিকে যশোরের ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার্থে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। পাশাপাশি সূর্যঘড়িটি সংরক্ষণেরও উদ্দ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ আজাহারুল ইসলাম বলেন, সূর্যঘড়িটির বিষয়ে আমি শুনেছি। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রেজিস্ট্রি অফিসের যেখানে সূর্যঘড়িটি রয়েছে সেখানে লোক পাঠানো হয়েছে। কিভাবে সূর্যঘড়িটিকে আবারও সচল করা যায় বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।
এই প্রাচীন সূর্যঘড়ির ইতিহাস রক্ষা করা এবং এটি আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সকলের দায়িত্ব। সূর্যঘড়িটি যেন হারিয়ে না যায়, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে একত্রে কাজ করার দাবি জানিয়েছে যশোরবাসী।
