রংপুরের অর্থনীতির প্রাণ কিন্তু বলা চলে হাড়িভাঙ্গা আম। এর অনন্য স্বাদ, সুগন্ধ এবং আঁশবিহীন বৈশিষ্ট্য এটিকে দেশজুড়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এক বৃক্ষপ্রেমী মানুষ নফল উদ্দিন পাইকারের হাত ধরে এই আমের গোড়াপত্তন হয়েছিল, এবং এরপর থেকে রংপুর জুড়ে হাজার হাজার হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান গড়ে ওঠে। এই আম বদলে দিয়েছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে রংপুরের আম চাষে এক নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা হাড়িভাঙ্গা আমের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
হাড়িভাঙ্গার কদর কমছে, কেন?
গত কয়েক বছর ধরে রংপুর জেলায় হাড়িভাঙ্গা আমের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। ফলস্বরূপ, বাজারে এর সরবরাহ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে আমের মূল্য অনেক কমে গেছে। চাষিরা বলছেন, এখন হাড়িভাঙ্গা আম চাষ করে আর তেমন লাভবান হওয়া যাচ্ছে না। যে আম একসময় সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাত, তা এখন লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অনেকের জন্য।
এছাড়াও, হাড়িভাঙ্গা আম পাকার পর ৩-৪ দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না, যা চাষিদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কার্যকর সংরক্ষণ পদ্ধতির অভাবে দ্রুত আম বিক্রি করতে হয়, ফলে অনেক সময় ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন তারা। যদিও হাড়িভাঙ্গা আম ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তবুও এর সঠিক বিপণন ও সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
নতুন জাতের উত্থান: আশার আলো:
হাড়িভাঙ্গা আমের এই মূল্যপতনের মুখে, রংপুরের আম চাষিরা এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উচ্চ ফলনশীল এবং বাজারে বেশি চাহিদা সম্পন্ন আমের জাত চাষে ঝুঁকছেন। জেলার বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে যেসব আমের বাগান গড়ে উঠছে, সেগুলোতে আর হাড়িভাঙ্গা দেখা যাচ্ছে না। বদলে শোভা পাচ্ছে নানা আকর্ষণীয় জাতের আম গাছ, যেমন:
গৌরমতি,ব্যানানা আম,কাটিমন,কিউজাই,চেংমাই, ব্রুনাই কিং, বারি ফোর,সূর্য ডিম,রেড পালমার সহ অনেক বিদেশি আমের জাত।
এইসব নতুন জাতের আম শুধু স্বাদে অতুলনীয় নয়, বরং এদের উচ্চ বাজার মূল্য চাষিদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই পরিবর্তন রংপুরের আম অর্থনীতিতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, যেখানে চাষিরা কেবল একটি নির্দিষ্ট জাতের উপর নির্ভরশীল না থেকে বৈচিত্র্য আনছেন।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া: পুরোনো বনাম নতুন:
তবে, এই পরিবর্তনের মাঝেও কিছু ভিন্ন মত রয়েছে। অনেক আম চাষি এখনো হাড়িভাঙ্গা আমকে তাদের প্রধান্য দিচ্ছেন। তারা মনে করেন, হাড়িভাঙ্গার ঐতিহ্য এবং নিজস্ব চাহিদা কখনোই পুরোপুরি শেষ হবে না। বিশেষ করে যারা ঐতিহ্যবাহী আম চাষের সাথে জড়িত, তারা এখনো হাড়িভাঙ্গার প্রতি বিশ্বস্ত। তাদের মতে, সঠিক বিপণন এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে হাড়িভাঙ্গা তার হারানো গৌরব হারাবেনা।
রংপুরের আম চাষে এই পরিবর্তন স্থানীয় কৃষকদের কৌশলগত সিদ্ধান্তের একটি সুস্পষ্ট প্রতিফলন। লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং বাজারের চাহিদা মেটাতে নতুন জাতের দিকে এই মোড় বদল ভবিষ্যতের জন্য কী বার্তা দেয়, তা সময়ই বলে দেবে। রংপুরের আম অর্থনীতি কি হাড়িভাঙ্গার ঐতিহ্য ধরে রেখেই নতুন জাতের মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ হবে, নাকি ধীরে ধীরে হাড়িভাঙ্গার জনপ্রিয়তা কমে যাবে?
