২ যুগ ধরে ঋণ করে শিক্ষার্থীদের পাশে জুড়ান মন্ডল

প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি গোপনে সুদে টাকা এনে শিক্ষার্থীদের নতুন বছরের উপহার দেন খাতা-কলম। গ্রামের দুই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপহার প্রদানকালে ছন্দ-কবিতায় গঠনমূলক বক্তৃতা দেন। এরপর সারা বছর দর্জি কাজ করে ওই সুদের টাকা পরিশোধ করেন। তিনি মনে করেন, নিজের সৎ উপার্জনের টাকায় কেনা খাতা-কলমে লেখাপড়া শুরু করলে সততা তৈরি হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে নিভৃতে এমন নির্মোহভাবে কর্তব্য পালনকারী সংস্কৃতিকর্মী জুড়ান মন্ডল এখন ভাল নেই। দারিদ্রতা-দুরবস্থার মধ্যে চিকিৎসাহীনভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। সমাজের নানা বিষয় নিয়ে নাটক, যাত্রাপালা, কবিতা, প্রবন্ধ লেখেন এবং তা নানা মঞ্চে উপস্থাপন করেন। জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকাতেও তার লেখা প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশ হয়েছে। কালের কন্ঠ ‘‘ব্যতিক্রম শিক্ষানুরাগী জুড়ান মন্ডল’ শিরোনামে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার এই ব্যতিক্রম মানুষকে নিয়ে ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম খবর প্রকাশ করেছিল। এরপর গতকাল সরেজমিনে চিতলমারীর বাখেরগঞ্জ বাজার এলাকা পরিদর্শনকালে জানা যায় জুড়ান মন্ডলের অসহায়ত্বের কথা। দেখা যায়, এক জরাজীর্ণ দোকান ঘরের মধ্যে জুড়ান মন্ডল কখনো কাপড় সেলাই করছেন। কখনো সেলাই মেশিনের পাশে থাকা কাগজ-কলম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছেন। কাঁপা কাঁপা হাতে বইয়ের গাদা হতে নিজের লেখা যাত্রাপালা ‘মানবিক স্বীকৃতি’,‘মানুষ পেলাম না’, কৌতুক নাটিকা ‘নাতির বিয়েতে’ বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন। তাঁর দর্জি দোকানের ঘরটিও ব্যতিক্রমভাবে সাজানো। দেয়ালে টানানো রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রহমান, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র সহ অসংখ্য মনীষির ছবি। তাকের একপাশে কাপড় এবং আরেক পাশে সাহিত্যেও বই সাজানো। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ পরিস্থিতির মধ্যেও নিয়মিত পত্রিকাও রাখেন। বহুল আলোচিত অ্যাডভোকেট কালিদাস বড়াল হত্যার পরে মাসব্যাপি প্রতিবাদ আন্দোলনকালে এই জুড়ান মন্ডল তার বুকে ও পিঠে ‘‘ আমরা সবাই বড়াল হবো- বড়াল হত্যার বদলা নেবো ’’ শ্লোগান লিখে মিডিয়া সহ সকলের আলোচনায় পরিণত হন। সন্তোষপুর গ্রামের মতিলাল মন্ডল ও যশোদা মন্ডলের ছেলে জুড়ান চন্দ্র মন্ডল (৬৫) জানান, ২০০০ সালে বাগেরহাটের নেতা আইনজীবি কালিদাস বড়ালকে হত্যার পর থেকে প্রতি বছর নিজ গ্রামের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নতুন বছরের উপহার হিসেবে খাতা-কলম দেন। কারণ, শিশুরা যেন লেখাপড়া শিখে কালিদাস বড়ালের মতো তেজী-জাগ্রত মানুষ হতে পারেন। শিক্ষা উপকরণ দিতে প্রতি বছর তার খরচ হয় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। সুদে এই টাকা আনেন এবং সারাবছর সততার পরিশ্রম দর্জি কাজ করে দেনা পরিশোধ করেন। তিন কাঠা জমিতে তার বসতবাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী মারা যায়। তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা জমাজমির কাজ করে। দর্জি পেশার আয়ে সংসার চলেনা। অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও হচ্ছে না। তবু তিনি লিখে চলেন কবিতা কিংবা অন্য কোন লেখা। সাহিত্যপ্রেমীদের পেলে আড্ডায় যেন সজাগ হয়ে ওঠে তাঁর রুগ্ন দেহ! জুড়ান মন্ডল বলেন, আমার মতো গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য লেখক। তাদের লেখাগুলো প্রকাশ এবং সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ যদি সরকার নিতো তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরো সুন্দর হতো। সন্তোষপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছায়া রানী ব্রহ্ম জানান, জুড়ান চন্দ্র মন্ডল আর্থিকভাবে দরিদ্র হলেও শিক্ষার তাঁর যে গভীর মমতা ও ভালবাসা রয়েছে তা এখন সাধারণত দেখা যায়না। ২০০১ সাল হতে প্রতি বছর নতুন শ্রেণিতে আসা শিক্ষার্থীদের তিনি খাতা-কলম উপহার দেন। তার লেখা নাটক বা যাত্রাপালা এলাকাবাসী মঞ্চস্থ করেন। তিনি বিভিন্ন সভায় যেসব বক্তব্য উপস্থাপন করেন তাতে সমাজের উপকার হয়। তাঁর দুুর্দিনে সবাইকে সহযোগিতার আহবান জানাই। সন্তোষপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান জানান, জুড়ান মন্ডল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও প্রতি বছর শিক্ষা উপকরণ দেন। তাঁর মতো মানুষের পাশে থাকা দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *