বাউল সম্রাট লালন শাহ’র জন্মভূমির জেলার এক গ্রামে বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ।

বাউল সম্রাট লালন শাহ জন্মভূমি নামে যে জনপদ বিশ্ব জুড়ে আলোচিত। সেই ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুন্ডু উপজেলার, ফলসী ইউনিয়নের একটি গ্রাম শড়াতলা।

গ্রামের সমাজপতিরা সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধ করেছে। এমন কি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও গ্রামটিতে ঢুকতে পারবেন না। এই নিয়ম অমান্য করলে গুনতে হবে জরিমানা। এমন  সিদ্ধান্ত নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাটানো হয়।

সমাজপতিদের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। তারা বলছেন, এটা বেআইনি।  তবে গ্রামের মানুষ এ বিষয়ে কথা বলতে না চাইলেও কেউ কেউ বলছেন এটি ভালো উদ্যোগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হরিণাকুন্ডু উপজেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে শড়াতলা গ্রামটি। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে ১০০ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্পের ফটোকপি সাটানো রয়েছে। তার প্রথম অংশে বড় করে লেখা, ‘সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধকরণের নোটিশ’।

ভেতরে লেখা রয়েছে, ‘গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে, সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো। যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সাথে তাদেরকে ৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে এবং তাদের পিতামাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

নোটিশে আরো উল্লেখ রয়েছে, ‘যেহেতু আমাদের গ্রামের ৯৫% মানুষ শিক্ষিত ও ২০ জনের মতো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছে। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে গ্রামবাসী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।’

নোটিশের শেষ অংশে ‘গ্রামবাসীর পক্ষে’ ১৯ জন সই করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি, শিক্ষক, ইমাম ও সমাজসেবক।

নোটিশে সই করা শড়াতলা গ্রামের পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি এনামুল হক বলেন, আগে আমাদের গ্রামে উচ্চ স্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। এতে অসুস্থ মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী, শিশুসহ অনেকের সমস্যা হতো। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বিভিন্ন সময়ে উচ্চ স্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচ-গান করে। এতে মানুষের সমস্যা হয়। তারা ও হকাররা নানা সময়ে মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মেম্বার তৌহিদুর রহমান বলেন, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। তাই তাদের সুবিধার জন্য গ্রামের সবার মতামতের ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে গ্রামের একাধিক মানুষ বলেন, গান-বাজনা শুনে আমাদের সন্তানরা বিপথে চলে যাচ্ছে। গ্রামের অনেক বাড়ি আছে জোরে সাউন্ড বক্স বাজায়। আমাদের নামাজ রোজা করা কষ্ট হয়ে ওঠে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফলসী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বজলুর রহমান বলেন, আমি অসুস্থ। ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছি। এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

খুলনা বিভাগের বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এর সভাপতি মন্ডলের সদস্য মো. নাজিম উদ্দিন জুলিয়াস বলেন, একজন সাংস্কৃতিক কর্মী ও সমাজের একজন সুধী মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করছি এটা ঠিক না।  তিনি বলেন আমার বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান হবে। শালীনতার মধ্য দিয়ে কি অনুষ্ঠান করব না করব এটা আমার দায়িত্ব। সমাজে যারা সমাজপতি আছেন কার বাড়ি কি হবে এটি নির্ধারণ করে দেয়া দায়িত্ব তো তাদের না। তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যারা তারা তো পৃথিবীতে ইচ্ছামত জন্মগ্রহণ করেননি। আল্লাহ তায়ালা কাকে কি রূপে পাঠান সেটা তো শুধু তিনিই জানেন। ওই গ্রামে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যেতে পারবে না তাদের অপরাধ টা কি? তিনি আরো বলেন বাউল সম্রাট লালন শাহ জন্মভূমি জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে। সেই হরিনাকুন্ডুর একটি গ্রামে এমন সিদ্ধান্তকে আমি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।

হরিনাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা  বি এম তারিক-উজ-জামান বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। এটি আইনবিরোধী। এভাবে কেউ নিয়ম তৈরি করতে পারে না।  তিনি বলেন,  গ্রামের পোস্টার গুলো সরিয়ে ফেলার জন্য থানার ওসি কে জানানো হয়েছে। সেই সাথে এই কর্মকান্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনগত ভাবে যা যা করণীয় আমরা সেই পদক্ষেপ নেব।

হরিনাকুন্ডু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ রউফ খান জানান, এ বিষয়ে কেউ এখনো লিখিত অভিযোগ দেননি।  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছিলেন পরে ওই গ্রামে পুলিশ পাঠিয়েছিলাম । এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *